🕌 কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে হাদীসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

হাদীস বা সুন্নাহ হলো ইসলামী শরী’আতের অন্যতম অপরিহার্য উৎস এবং কুরআনের পরই এর স্থান। এটি মূলত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কথা, কাজ ও নীরব সমর্থন।

১. কুরআনের দৃষ্টিতে হাদীসের গুরুত্ব (Authority of Hadith in the Quran)

কুরআন মাজীদে একাধিক আয়াতে রাসূল (সাঃ)-এর অনুসরণ ও আনুগত্যের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশই হাদীসের শাস্ত্রীয় ভিত্তির মূল উৎস:

ওহীর উৎস হিসেবে হাদীস:“আর তিনি (রাসূল) মনগড়া কথাও বলেন না, এ তো ওহী যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।” (সূরা আন-নাজম: ৩-৪)
- এই আয়াত প্রমাণ করে যে, রাসূলের (সাঃ) বক্তব্যও আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত ওহী (পরোক্ষ ওহী বা সুন্নাহ)।
আনুগত্য ও অনুকরণের নির্দেশ:“বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।” (সূরা আলে-ইমরান: ৩১)”রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা থেকে নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো।” (সূরা আল-হাশর: ৭)”তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (সূরা আল-আহযাব: ২১)
- এই আয়াতগুলো রাসূল (সাঃ)-এর জীবনাদর্শ (সুন্নাহ/হাদীস) অনুসরণকে মুসলিমদের জন্য অপরিহার্য করে দেয়।
কুরআনের ব্যাখ্যা হিসেবে হাদীস:
- কুরআন ইসলামের মৌলিক নীতিগুলো প্রদান করে, আর হাদীস সেই নীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যা, কার্যকারিতা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি বলে দেয়। যেমন, কুরআনে সালাত (নামাজ) ও যাকাত আদায়ের নির্দেশ থাকলেও রাকাতের সংখ্যা, পদ্ধতি বা যাকাতের পরিমাণ হাদীসের মাধ্যমেই জানা যায়।

২. হাদীস সংকলনের ইতিহাস (Brief History of Hadith Compilation)

হাদীসের ইতিহাসকে প্রধানত তিনটি যুগে ভাগ করা যায়:

ক. নবুয়তের যুগ (রাসূল (সাঃ)-এর জীবদ্দশা)

সংরক্ষণ পদ্ধতি: এই যুগে হাদীস মূলত সাহাবীগণের মুখস্থ, চর্চা ও বাস্তব অনুসরণের মাধ্যমে সংরক্ষিত হতো।
লিখন পদ্ধতি: প্রথম দিকে রাসূল (সাঃ) কুরআনকে হাদীস থেকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে হাদীস লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন। তবে পরবর্তীকালে বিশেষ অনুমতি ও প্রয়োজনের তাগিদে কিছু সাহাবী ব্যক্তিগতভাবে হাদীস লিপিবদ্ধ করেন। যেমন: আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ)-এর ‘সহীফায়ে সাদিকা’ অন্যতম।

খ. সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগ (রাসূল (সাঃ)-এর ওফাতের পর থেকে দ্বিতীয় হিজরী শতক)

লিখিত সংকলন শুরু: দ্বিতীয় হিজরী শতকের শুরুর দিকে উমাইয়া খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) আনুষ্ঠানিকভাবে হাদীস সংকলনের নির্দেশ দেন। এর কারণ ছিল:
- সাহাবীগণের অনেকে শহীদ বা মৃত্যুবরণ করায় হাদীস বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা।
- ইসলামী রাষ্ট্রের বিস্তার লাভ ও বিভিন্ন অঞ্চলে জাল হাদীসের বিস্তার রোধ করা।
প্রাথমিক সংকলন: এই সময়ে ইমাম মালিক (রহঃ) রচিত ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’ উল্লেখযোগ্য, যা প্রথম দিকের পূর্ণাঙ্গ হাদীস সংকলন।

গ. সংকলন ও যাচাই-বাছাইয়ের যুগ (দ্বিতীয় হিজরী শতকের শেষ থেকে শুরু)

বিশুদ্ধতা যাচাই: এই যুগে মুহাদ্দিসগণ হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ে কঠোর পদ্ধতি (যেমন: সনদ ও মতন যাচাই) অনুসরণ করেন।
সিহাহ সিত্তাহ সংকলন: এই সময়েই ইসলামের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ছয়টি হাদীস গ্রন্থ বা ‘সিহাহ সিত্তাহ’ সংকলিত হয়। এগুলোর মধ্যে ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর ‘সহীহ বুখারী’ এবং ইমাম মুসলিম (রহঃ)-এর ‘সহীহ মুসলিম’ সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করে।

হাদীস গ্রন্থ	সংকলক	পরিচিতি
সহীহ বুখারী	ইমাম বুখারী (রহঃ)	বিশুদ্ধতম হাদীস গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত।
সহীহ মুসলিম	ইমাম মুসলিম (রহঃ)	বুখারীর পরেই এর স্থান।
সুনানে আবূ দাঊদ	ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ)	ফিকহ (আইনশাস্ত্র) ভিত্তিক হাদীস সংকলন।
সুনানে তিরমিযী	ইমাম তিরমিযী (রহঃ)	হাদীসের বিভিন্ন স্তর ও ফিকহী মতভেদ তুলে ধরেছেন।
সুনানে নাসায়ী	ইমাম নাসায়ী (রহঃ)	বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে অন্যতম।
সুনানে ইবনে মাজাহ	ইমাম ইবনে মাজাহ (রহঃ)	এই ছয়টি গ্রন্থই ইসলামী আইনের অন্যতম প্রধান উৎস।

পরিশেষ:

হাদীস হলো কুরআনের বাস্তব রূপায়ণ এবং ইসলামী জীবনবিধানের পথনির্দেশিকা। কুরআন মাজীদে রাসূলের (সাঃ) আনুগত্যের যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, হাদীসের মাধ্যমেই মুসলিম উম্মাহ সেই নির্দেশকে তাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কার্যকর করার পদ্ধতি খুঁজে পায়।

ওহীর আলো